সূরা আস-সাজদাহ একটি গভীরভাবে প্রতিফলিত এবং আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী অধ্যায় যা পুনরুত্থানের বাস্তবতা, মানব জীবনের উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর অপরিসীম করুণা ও কর্তৃত্বের উপর জোর দেয়।
সূরা ৩২: আস-সাজদা (সিজদা)
ভূমিকা
সূরা আস-সাজদাহ পবিত্র কুরআনের ৩২তম সূরা এবং মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এটি ৩০টি আয়াত নিয়ে গঠিত এবং ১৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত সিজদার নাম থেকে এর নামকরণ করা হয়েছে, যেখানে প্রকৃত মুমিনদের বর্ণনা করা হয়েছে যারা তাদের প্রভুর স্মরণে উপাসনায় লুটিয়ে পড়ে। এই সূরাটি ঐশ্বরিক প্রকাশ, পুনরুত্থান, পুরস্কার ও শাস্তি এবং মুমিন ও কাফেরদের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়বস্তুগুলির উপর আলোকপাত করে।
এই সূরাটি কুরআনের ঐশ্বরিক উৎসকে নিশ্চিত করে, নবীর বাণীর প্রতি সন্দেহ পোষণকারীদের সম্বোধন করে এবং তাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহ হলেন সবকিছুর স্রষ্টা এবং শাসক। এটি জোর দিয়ে বলে যে মানুষ এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টি আল্লাহর শক্তির একটি নিদর্শন এবং মৃত্যুর পরের জীবন একটি নিশ্চিত বিষয়। এই সূরার একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এটি কীভাবে ধার্মিকদের চিরন্তন পুরস্কার এবং বিশ্বাস প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য অপেক্ষারত শাস্তির তুলনা করে।
পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলি কীভাবে ঐশ্বরিক নির্দেশনা পেয়েছিল এবং ধৈর্যশীল এবং বিশ্বাসে দৃঢ় ব্যক্তিদের নেতৃত্ব কীভাবে আসে তার উদাহরণ হিসেবে হযরত মুসার কাহিনী সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরাটি পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলির কথাও উল্লেখ করে কাফেরদের অহংকার এবং গাফিলতির পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে।
সামগ্রিকভাবে, সূরা আস-সাজদাহ চিন্তাভাবনা, আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ এবং পরকালের জন্য আন্তরিক প্রস্তুতির আহ্বান জানায়। এটি শ্রোতাকে কেবল জিহ্বা দিয়ে বিশ্বাস করার জন্য নয়, বরং আল্লাহর প্রতি নম্রতা, ভয় এবং আশা প্রদর্শনের জন্য আহ্বান জানায় – বিশেষ করে আন্তরিকভাবে এবং নিয়মিতভাবে তাঁর উপাসনা করে। ০ ০ ০
সূরা ৩২: আস-সাজদাহ (সিজদা): পাঠ্য
পরম করুণাময়, দয়ালু আল্লাহর নামে।
১. আলিফ, লাম, মীম।
২. এই কিতাবের অবতীর্ণকরণ—নিঃসন্দেহে—সমস্ত বিশ্বজগতের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে।
৩. নাকি তারা বলে, ‘সে এটা বানিয়েছে’? না! এটা তোমার প্রভুর কাছ থেকে সত্য, যাতে তুমি এমন এক জাতিকে সতর্ক করতে পারো যাদের কাছে তোমার পূর্বে কোন সতর্ককারী আসেনি, যাতে তারা সৎপথে চলে।
৪. আল্লাহই আসমান, জমিন এবং তাদের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশের উপর সমাসীন হয়েছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক বা সাহায্যকারী নেই। তাহলে কি তোমরা স্মরণ করবে না?
৫. তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সকল বিষয় পরিচালনা করেন। অতঃপর তারা তাঁর কাছে ফিরে আসে এমন এক দিনে যার দৈর্ঘ্য তোমাদের গণনায় হাজার বছরের সমান।
৬. তিনিই দৃশ্যমান ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, পরাক্রমশালী, পরম করুণাময়।
৭. তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর সৃষ্টির সবকিছুকে নিখুঁত করেছেন। তিনি মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন।
৮. অতঃপর তিনি তার সন্তান সন্ততি সৃষ্টি করলেন এক ফোঁটা নীচু জলকণা থেকে,
৯. তারপর তিনি তাকে আকৃতি দান করলেন এবং তার মধ্যে তাঁর রূহ ফুঁকে দিলেন। তিনি তোমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং অন্তর দিলেন। কিন্তু তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।
১০. আর তারা বলে, ‘আমরা যখন মাটিতে মিশে যাব, তখন কি আমাদের নতুন করে সৃষ্টি করা হবে?’ বরং তারা তাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎকে অস্বীকার করে।
১১. বলো, ‘তোমাদের উপর নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। তারপর তোমাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরিয়ে আনা হবে।’
১২. যদি তুমি দেখতে, যখন পাপীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে মাথা নত করবে এবং বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা এখন দেখেছি এবং শুনেছি। সুতরাং আমাদেরকে আবার পাঠাও যাতে আমরা সৎকর্ম করতে পারি। আমরা এখন নিশ্চিত।’
১৩. যদি আমি ইচ্ছা করতাম, তাহলে প্রত্যেক প্রাণীকে তার সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পারতাম। তবে আমার কথা পূর্ণ হয়েছে: ‘আমি অবশ্যই জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করব।’
১৪. অতএব, তোমরা শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করো কারণ তোমরা তোমাদের এই দিনের সাক্ষাৎ ভুলে গেছো। আমরাও তোমাদের ভুলে গেছি। তোমরা যা করতে তার জন্য চিরস্থায়ী শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করো।
১৫. আমার আয়াতসমূহের প্রতি প্রকৃত বিশ্বাস স্থাপনকারী তারাই, যারা সেগুলো স্মরণ করিয়ে দিলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং অহংকার না করে তাদের পালনকর্তার প্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।
১৬. রাতের বেলায় তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে দূরে থাকে, ভয় ও আশায় তাদের পালনকর্তাকে ডাকে এবং আমি তাদেরকে যা দিয়েছি তা থেকে দান করে।
১৭. কোন ব্যক্তিই জানে না যে, তাদের কর্মের প্রতিদান হিসেবে তাদের জন্য কী আনন্দ ও সান্ত্বনা লুকানো আছে।
১৮. মুমিন কি বিদ্রোহীর মতো? তারা সমান নয়।
১৯. যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী বসবাসের জান্নাত, তাদের কর্মের প্রতিদান হিসেবে।
২০. কিন্তু যারা অবাধ্যতা করেছে – জাহান্নামই তাদের আবাসস্থল। যখনই তারা সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করবে, তখনই তাদের পিছনে ঠেলে দেওয়া হবে এবং বলা হবে, ‘তোমরা যে আগুনের শাস্তিকে অস্বীকার করতে, তার স্বাদ গ্রহণ করো।’
২১. আর অবশ্যই আমি তাদেরকে (পরকালে) বড় শাস্তির পূর্বে (এই পৃথিবীতে) ছোট শাস্তি আস্বাদন করাবো, যাতে তারা ফিরে আসে।
২২. তার চেয়ে বেশি জালেম আর কে, যাকে তার পালনকর্তার আয়াতসমূহ দ্বারা উপদেশ দেওয়া হয়, অতঃপর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? আমি অবশ্যই অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ নেব।
২৩. আর অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম, অতএব তার সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে তুমি সন্দেহ করো না। আমি একে বনী-ইসরাঈলের জন্য পথপ্রদর্শক করেছিলাম।
২৪. আর আমরা তাদের মধ্যে এমন নেতা নিযুক্ত করেছিলাম যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্য ধারণ করত এবং আমার নিদর্শনাবলীতে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করত।
২৫. নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তা কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে সেই বিষয়ের ফয়সালা করবেন, যে বিষয়ে তারা মতভেদ করত।
২৬. তাদের জন্য কি এটা শিক্ষণীয় নয় যে, তাদের পূর্বে আমি কত প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছি, যাদের ঘরবাড়ি দিয়ে তারা এখন চলাফেরা করে? নিঃসন্দেহে এতে নিদর্শন রয়েছে, তারা কি শুনবে না?
২৭. তারা কি দেখে না যে, আমি শুষ্ক ভূমিতে পানি প্রবাহিত করি এবং তা থেকে তাদের গবাদি পশুর জন্য এবং তাদের নিজেদের জন্য ফসল উৎপন্ন করি? তবুও কি তারা দেখে না?
২৮. আর তারা বলে, ‘যদি তোমরা সত্যবাদী হও, তাহলে এই বিজয় কখন আসবে?’
২৯. বলো, ‘বিজয়ের দিন কাফেরদের বিশ্বাস তাদের কোন কাজে আসবে না এবং তাদের আর কোন সময় দেওয়া হবে না।’
৩০. অতএব, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং অপেক্ষা করো। তারাও অপেক্ষা করছে। ০ ০ ০
You May Like: সূরা ২৭: আন-নামল (পিঁপড়া)
মন্তব্য
সূরা আস-সাজদাহ একটি গভীরভাবে প্রতিফলিত এবং আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী অধ্যায় যা পুনরুত্থানের বাস্তবতা, মানব জীবনের উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর অপরিসীম করুণা ও কর্তৃত্বের উপর জোর দেয়। এটি পাঠককে মনে করিয়ে দেয় যে জীবন অর্থহীন বা পরিণতিহীন নয় এবং প্রতিটি আত্মাই শেষ পর্যন্ত বিচারের জন্য তার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাবে। সূরাটি তাদের ভাগ্যের মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য উপস্থাপন করে যারা বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে এবং যারা আল্লাহর নিদর্শন উপেক্ষা করে এবং পরকালকে অস্বীকার করে জীবনযাপন করে।
এই সূরার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলির মধ্যে একটি হল এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে আল্লাহই হলেন সেই যিনি আকাশ ও পৃথিবী থেকে শুরু করে মানুষের আত্মার গঠন পর্যন্ত সবকিছু উদ্দেশ্য এবং নির্ভুলতার সাথে সৃষ্টি করেছেন। এটি আল্লাহর অদৃশ্য জ্ঞান, সময়ের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ এবং মৃত্যুর পরে জীবন দেওয়ার ক্ষমতা তুলে ধরে, যারা ঐশ্বরিক সত্যের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে তাদের অহংকারকে চ্যালেঞ্জ করে। ঐশ্বরিক ওহীর প্রতিক্রিয়া হিসাবে সিজদার উল্লেখ আত্মসমর্পণের একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবেও কাজ করে, যা দেখায় যে প্রকৃত বিশ্বাস কেবল কথায় নয়, বরং আল্লাহর সামনে কর্ম এবং নম্রতার মধ্যেও রয়েছে।
এই সূরাটি বিশ্বাসীদের ধৈর্য ধরতে, ঐশ্বরিক ন্যায়বিচারের উপর আস্থা রাখতে এবং এই পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির দ্বারা কখনও প্রতারিত না হতে উৎসাহিত করে। এটি এমন একটি অধ্যায় যা প্রতিটি চিন্তাশীল পাঠককে ভবিষ্যতের অনন্ত জীবনের জন্য প্রতিফলন, আত্মসমর্পণ এবং আন্তরিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ০ ০ ০
সূরা 32: আস-সাজদা: অতিরিক্ত তথ্য
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন: সূরা আস- সাজদা
প্রশ্ন ১. সূরা আস-সাজদা কী সম্পর্কে?
সূরা আস-সাজদা সৃষ্টিতে আল্লাহর ক্ষমতা, পুনরুত্থানের সত্যতা এবং কুরআনের মাধ্যমে প্রকাশিত নির্দেশনা সম্পর্কে। সূরা আস-সাজদা জোর দিয়ে বলে যে মানুষকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে এবং আন্তরিক বিশ্বাসীদের বিনয় ও সিজদার মাধ্যমে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করা উচিত।
প্রশ্ন ২. কেন এটিকে সূরা আস-সাজদা বলা হয়?
এটিকে সূরা আস-সাজদা বলা হয় কারণ এতে সিজদার একটি আয়াত রয়েছে যেখানে মুমিনদের আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। সূরা আস-সাজদা বিনয়, ভক্তি এবং ঐশ্বরিক কর্তৃত্বের স্বীকৃতির প্রতীক হিসেবে সিজদার আধ্যাত্মিক কাজকে তুলে ধরে।
প্রশ্ন ৩. সূরা আস-সাজদার মূল বিষয়বস্তু কী?
মূল বিষয়বস্তুগুলির মধ্যে রয়েছে সৃষ্টি, প্রকাশ, পুনরুত্থান, সৎকর্মশীলদের জন্য পুরস্কার এবং কাফেরদের শাস্তি। সূরা আস-সাজদা ঈমান, ধৈর্য এবং ইবাদতের গুরুত্বের উপরও জোর দেয়, বিশেষ করে আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের প্রতিফলনকারী সিজদার কাজ।
প্রশ্ন ৪. সূরা আস-সাজদা সাধারণত কখন পাঠ করা হয়?
মুমিনদের পুনরুত্থান এবং জবাবদিহিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য শুক্রবার ফজরের নামাযে সূরা আস-সাজদা প্রায়শই সূরা আল-ইনসানের সাথে পাঠ করা হয়। সূরা আস-সাজদা তেলাওয়াত গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ বহন করে, কারণ এটি মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে সচেতনতা পুনর্নবীকরণ করে এবং সিজদার মাধ্যমে বিনয়কে শক্তিশালী করে।
প্রশ্ন ৫. সূরা আস-সাজদাতে সিজদার তাৎপর্য কী?
সূরা আস-সাজদাতে সিজদার তাৎপর্য নিহিত রয়েছে মুমিনের আল্লাহর সামনে নিজেকে নত করার, তাঁর মহত্ত্ব এবং করুণা স্বীকার করার মধ্যে। সূরা আস-সাজদা শিক্ষা দেয় যে সিজদা হৃদয়কে পবিত্র করে, আত্মায় শান্তি আনে এবং স্রষ্টার সাথে ব্যক্তির সংযোগকে শক্তিশালী করে। ০ ০ ০






